মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক অধিকার আন্দোলনের অন্যতম প্রাণপুরুষ মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র দেহ নিয়ে বেঁচে ছিলেন মাত্র ৩৯ বছর অথচ আজও তিনি যেকোনো আন্দোলন সংগ্রামে প্রেরণার নাম, শক্তির নাম। নিজের জীবন ও কর্ম মানুষের কল্যাণে নিবেদন করে তিনি শিখিয়ে গেছেন ঐক্যবদ্ধ হলে চরম প্রতিকূলতাও কাটিয়ে উঠা সম্ভব। যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর সময়ে নাগরিক অধিকার আন্দোলনে সবচেয়ে সক্রিয় নেতাদের একজন ছিলেন। একাধারে তিনি ছিলেন একজন ব্যাপ্টিস্ট ধর্মযাজক। বর্ণবাদের বিরুদ্ধে অহিংস আন্দোলনের জন্য মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র ১৯৬৪ সালে মাত্র ৩৫ বছর বয়সে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হন।
নাগরিক আন্দোলনের কিংবদন্তি নেতা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র ১৯২৯ সালের ১৫ জানুয়ারি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের আটলান্টা শহরে এক কৃষ্ণাঙ্গ যাজক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পূর্বপুরুষদের বেশিরভাগই ছিলেন ব্যাপ্টিস্ট যাজক। মাইকেল কিং সিনিয়র ও আলবার্টা উইলিয়ামস কিংয়ের তিন সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। প্রথমে তাঁর নাম রাখা হয় মাইকেল কিং জুনিয়র। ১৯৩৪ সালে ছেলের ছয় বছর বয়সে বাবা মাইকেল কিং বিখ্যাত জার্মান সংস্কারক, ধর্মযাজক এবং ধর্মতত্ত্বের অধ্যাপক মার্টিন লুথারের নামানুসারে ছেলের নাম রাখেন মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র।
লুথার কিং আটলান্টার মোরহাউস কলেজে পড়াশোনা শেষে বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব থিওলজি থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। শিক্ষাজীবন শেষে তিনি যাজক হিসাবে যোগ দেন অ্যালাবামার মন্টগোমারির ডেক্সটার অ্যাভিনিউ ব্যাপটিস্ট চার্চে।
১৯৬৩ সালের ২৮ আগস্ট ওয়াশিংটনের লিংকন মেমোরিয়ালের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ‘আই হ্যাভ অ্যা ড্রিম’ ভাষণের মধ্যদিয়ে স্মরণীয় হয়ে আছেন সমগ্র বিশ্বের মানবতাবাদী মানুষের অন্তরে। শান্তিপূর্ণ প্রতিরোধের মধ্যদিয়েই পরিবর্তন আসতে পারে এই আত্মবিশ্বাস তিনি পেয়েছেন ভারতে ব্রিটিশ শাসন আমলে ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রধান নেতা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী বা মহাত্মা গান্ধীর নিকট হতে। মহাত্মা গান্ধীর অহিংস আন্দোলনের নীতি গ্রহণ করে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে জাতিগত সাম্য প্রতিষ্ঠায় জীবন উৎসর্গ করে মানবতাবাদী মানুষের হৃদয়ে বেঁচে আছেন আজও। ‘আই হ্যাভ অ্যা ড্রিম’ খ্যাত সেই ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি বর্ণনা করেন, বর্ণবৈষম্য কিভাবে গোটা জাতিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে, শুধু কালো আমেরিকানদের জীবনকে নয়। তারপর তিনি স্বপ্নের আমেরিকার কথা তুলে ধরেন যেখানে সকল নাগরিকের অধিকার থাকবে সমান।
লিংকন মেমোরিয়ালের সিঁড়িকে তিনি গীর্জার বেদীতে পরিণত করে বৈষম্যমূলক সমাজে আফ্রিকান-আমেরিকানদের বঞ্চনার কথা, আশাবাদের কথা সহজ-সরল ভাষায় উপস্থাপন করেন। কিংয়ের ভাষণ আমেরিকার টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচারিত হয়। যার ফলে পুরো যুক্তরাষ্ট্রসহ সারাবিশ্বে তুমুল সাড়া ফেলে সেই ভাষণ। প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডিসহ যুক্তরাষ্ট্রের অনেক নাগরিক তার ভাষণ শুনেছেন। তাৎক্ষণিকভাবেই এটি ঐতিহাসিক ভাষণ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এই বিখ্যাত ভাষণের প্রভাবেই ১৯৬৪ সালে আমেরিকায় নাগরিক অধিকার আইন ও ১৯৬৫ সালে ভোটাধিকার আইন প্রণয়ন করা হয়। বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে ও কৃষ্ণাঙ্গদের সমঅধিকার আদায়ে লড়ে গেছেন আমৃত্যু। তাঁর নেতৃত্বে আমেরিকায় কালো মানুষ পেয়েছে সাদা মানুষের সমান অধিকার। সেই বছর বিশ্বখ্যাত টাইমস পত্রিকা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রকে বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ হিসেবে ‘ম্যান অব দ্য ইয়ার’ পুরস্কার প্রদান করে।
লড়াই কখনও পিছু ছাড়েনি কিংয়ের জীবনে, এমনকি মৃত্যুর পরও লড়তে হয়েছে ! মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র দিবস পালন করার অনুমোদন পেতেও লেগেছে ১৫ বছর ! আমেরিকার রক্ষণশীল ও বর্ণবাদ মনোভাবের শাসকগোষ্ঠী সবসময়ই তাঁকে উগ্রবাদী, কমিউনিস্ট হিসেবেই চিহ্নিত করে গেছে। তাই কিংয়ের জন্মদিনকে সরকারি ছুটি হিসেবে পালনের প্রস্তাব বার বার নাকচ হয়। অবশেষে সেখানেও জনগণের শক্তি প্রয়োগ করতে হয়েছে। ১৯৭৯ সালে লাখ লাখ নাগরিকের আবেদনের প্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের জন্মদিনকে জাতীয় ছুটির দিন হিসেবে পালনের আইন পাশ করে।
আমেরিকায় কালো মানুষদের প্রতি বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য প্রতিবাদী কন্ঠস্বর মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র। ১৯৬৮ সালের ২৯ মার্চ মার্টিন লুথার কিং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলীয় অঙ্গরাজ্য টেনেসির মেমফিসে ‘ব্ল্যাক স্যানিটারি পাবলিক ওয়ার্কস এমপ্লয়ি’-দের এক সংগঠনের ডাকে ধমর্ঘটে অংশ নিতে সেখানে যান। মেমফিসে ৩ এপ্রিল পর্যন্ত ব্যস্ত সময় পার করেন। সতীর্থদের নিয়ে রাতে মেমফিসে অবস্থিত ‘লরেইন মোটেলে’ থাকতেন। পরদিন লরেইন মোটেলের নিজ রুমের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ছিলেন। হঠাৎ করে উগ্রবাদী শেতাঙ্গ এক যুবকের ছুড়া বুলেট মার্টিন লুথার কিংয়ের ডান গাল ভেদ করে রক্তাক্ত করে শরীর। জ্ঞান হারিয়ে বারান্দায় পড়ে যান। ঐদিনই সন্ধ্যায় সেন্ট জোসেফ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। নিজের রক্ত ঢেলে যিনি মুছতে চেয়েছেন বর্ণবাদের বিষ, নিয়তির কী নির্মম পরিহাস শেষ পর্যন্ত নিজেই বর্ণবাদ বৈষম্যের শিকার হয়ে ১৯৬৮ সালের ৪ এপ্রিল টেনেসির মেমফিস শহরে সেন্ট জোসেফ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। উগ্রপন্থী আততায়ীর গুলি হয়তো তাঁর দেহটাকে সরিয়ে দিতে পেরেছে কিন্তু নাগরিক আন্দোলনের মহান নেতার আদর্শ একটুও মুছে দিতে পারেনি।
ওয়াশিংটন ডিসির যে জায়গায় দাঁড়িয়ে ১৯৬৩ সালের ২৮ আগষ্ট, উচ্চারণ করেছিলেন ‘আই হ্যাভ অ্যা ড্রিম’, দেখেছিলেন ভবিষ্যতের আমেরিকার স্বপ্ন, নাগরিক আন্দোলনের নেতা, নোবেল শান্তি পুরস্কার জয়ী মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র, ঠিক সেই জায়গাটির অদূরেই তাঁর স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। ভাষ্কর্যের নামকরণ করা হয় ‘স্টোন অব হোপ’। মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের ‘আই হ্যাভ অ্যা ড্রিম’ বক্তৃতার একটি লাইন ‘Out of the mountain of despair, a stone of hope’, অর্থাৎ হতাশার পাহাড় থেকে আশার পাথর-এই লাইনটির প্রতি অনুপ্রাণিত হয়ে স্মৃতিস্তম্ভটির নকশা করা হয়। ২০১১ সালের ১৬ অক্টোবর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৪ তম প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা স্মৃতিস্তম্ভ উন্মাচন করেন। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ৩০ ফুট উঁচু গ্রানাইটের মূর্তিটির দিকে তাকিয়ে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের প্রতি সশ্রদ্ধ স্যালুট জানান।
যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর জানুয়ারি মাসের তৃতীয় সোমবার মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র দিবস পালন করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় এ বছর ১৬ জানুয়ারি, সোমবার পালিত হচ্ছে মার্টিন লুথার কিং দিবস। এ দিনটিতে কিংয়ের স্মৃতির প্রতি রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রদর্শন করা হয়। সেইসঙ্গে নিজ নিজ এলাকায় স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজ করতে নাগরিকদের অনুপ্রাণিত করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তিন ব্যক্তির জন্য রাষ্ট্রীয় ছুটি পালিত হয় থাকে। এরা হলেন- যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট স্বাধীনতার কারিগর জর্জ ওয়াশিংটন, যুক্তরাষ্ট্র আবিষ্কারক ক্রিস্টোফার কলম্বাস এবং কিংবদন্তি মার্টিন লুথার কিং। আর এই তিনের মাঝে কিং-ই যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণকারী ব্যক্তি যার সম্মানে জাতীয় ছুটির পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে কানাডার টরন্টো এবং জাপানের হিরোশিমাতে মার্টিন লুথার কিং দিবস পালন করা হয়।
মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের স্বপ্ন ও ঐক্যের দৃষ্টিভঙ্গি আজও যেকোনো লড়াই-সংগ্রামে শক্তি যোগায়, প্রেরণা দেয়। কেবল আমেরিকা নয় বরং গোটা বিশ্বে তিনি আজও নাগরিক আন্দোলনে শক্তি ও প্রেরণার উৎস হয়ে বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন নাগরিক আন্দোলন যতদিন পৃথিবীতে আছে।