আধুনিক সমাজের বিষবাষ্প হচ্ছে বর্ণবৈষম্য। কালো থেকে ফর্সা, উচ্চ বর্ণ-নিম্ন বর্ণ, গোত্র থেকে গোত্র এতসব ভেদাভেদ নির্মূলে যুগে যুগে কালে কালে গুণী ব্যক্তিবর্গরা নিজেদের জীবন বাজি রেখে লড়েছেন। মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র, নেলসন ম্যান্ডেলা এই নামগুলো মানুষের হৃদয়ে স্থান নিয়েছে বর্ণবাদ-বিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবী হিসেবে। তেমনি এক আলোকিত নাম রোজা লুইস ম্যাকলি পার্কস। তাঁর সময়ে আমেরিকায় মাথাচাড়া দিয়ে বিস্তার গজায় বর্ণবাদের। যুক্তরাষ্ট্রের অ্যালাবামা রাজ্যে তৎকালীন সময়ে বর্ণবাদী একটি আইনের মাধ্যমে শ্বেতাঙ্গদের দেওয়া হতো বিশেষ সুবিধা। আইন অনুযায়ী প্রত্যেক বাসের প্রথম চার সারির প্রথম দশ সিটে সাদা চামড়ার মানুষ বসবে। আর একেবারে পেছনের থেকে শুরু করে চার সারির দশ সিটে বসবে কৃষ্ণাঙ্গরা। এদিকে মাঝের ষোলটি সিটেই শুরু হলো বর্ণবাদ। নিয়ম করে মাঝখানের সামনের অংশ সাদা চামড়ার মানুষদের আর পিছনের অংশ কৃষ্ণাঙ্গদের। বাসের হেলপারেরা এই কাজের সুবিধার্থে একটা বোর্ড বানিয়ে নিয়েছিলো। তারা সুবিধামতো জায়গায় বসিয়ে সাদাদের আসন চিহ্নিত করতো। যাত্রীদের আসন পূর্ণ হয়ে গেলে সুবিধামতো এই চিহ্ন পিছিয়ে আনা হতো এবং বেশিরভাগই সাদাদের সুবিধার্তে হতো অদল-বদল। কখনো বাস সম্পূর্ণ শ্বেতাঙ্গ দিয়ে ভরাট হলে কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে সবার প্রথম সারির চারজনকেই আসন ছেড়ে দিতে হতো। সাদা আর কালো কি আর পাশাপাশি বসতে পারে! একেবারে পেছনে দাঁড়িয়ে থাকার কষ্ট তো আছেই সেইসাথে আবার শ্বেতাঙ্গদের জন্যে বরাদ্দ মাঝখানের জায়গা ভরাট হলে সেই রাস্তা দিয়ে কালোদের হেটে যাওয়াও নিষেধ। তাই বাসে উঠতে হলে প্রথমে সামনের দরজা দিয়ে ভাড়া চুকিয়ে আবার পেছনের দরজা দিয়ে উঠতে হতো। এমনও হয়েছে ভাড়া দিয়ে পেছনে উঠবার আগেই ড্রাইভার বাস ছেড়ে দিতো! ১৯৫৫ সালের ১ ডিসেম্বর সারা দিনের কাজের শেষে রোজা পার্কস অপেক্ষা করছেন বাসের জন্য। মন্টেগোমারি সিটি লাইন কোম্পানির একটি পুরনো চেহারার বাস এলো। পার্কস উঠে পড়লেন সেই ক্লিভল্যান্ড এভিনিউ বাসে। ভাড়া মিটিয়ে তিনি এসে বসলেন শ্বেতাঙ্গ যাত্রীদের সিট যেখানে শেষ হয়েছে ঠিক তার পেছনের পঞ্চম সারির একটি সিটে। সেই চিহ্ন দেয়ার বোর্ডটি তখন ঐ চতুর্থ সারি পর্যন্তই রাখা ছিলো। কিন্তু কয়েকজন শ্বেতাঙ্গ বাসে উঠায় তাদের জন্য সিট ছেড়ে দিতে বলে বাসের লোক। তিনজন সিট ছেড়ে দিলেও সিট ছেড়ে উঠলেন না রোজা পার্কস, শুধু একটু সরে জানলার পাশের সিটে গিয়ে বসলেন।এই কাজের জন্য তাঁকে জেলে যেতে হলো অথচ তিনি শ্বেতাঙ্গদের জন্য বরাদ্দকৃত সিটে বসেননি, বরং কালোদের সিটেই বসেছিলেন। আইনভঙ্গের অভিযোগে গ্রেফতার হলেন তিনি। পার্কসের গ্রেফতার হবার ঘটনা যেন এত দিন চলে আসা আন্দোলনের ক্ষোভের আগুনকে স্ফুলিঙ্গের মত জ্বালিয়ে দিলো। বাস বয়কটের সিদ্ধান্ত নিলেন কৃষ্ণাঙ্গ নেতারা। বয়কটের আহ্বান জানিয়ে উইমেনস পলিটিক্যাল কাউন্সিল নামের একটি সংগঠন ৩৫,০০০ হ্যান্ডবিল ছাপালো। ডিসেম্বরের ৪ তারিখ রাতে কৃষ্ণাঙ্গদের চার্চগুলোতে সবাই সমবেত হয়ে একাত্ম হলেন বয়কটের ঘোষণায়, তিন দাবি- ভদ্র আচরণ নিশ্চিত করা, কালো ড্রাইভার নিযুক্তি এবং মাঝখানের সিটগুলোতে আগে আসলে আগে বসার ভিত্তিতে বাসের আসন বরাদ্দ করা- এই দাবিগুলো মেনে না নেওয়া পর্যন্ত বাস বয়কট করবেন তাঁরা। পরদিন ৫ ডিসেম্বরে পার্কসের বিচারে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে মোট ১৪ ডলার জরিমানা করা হয়। পার্কস রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন এবং আনুষ্ঠানিকভাবে আদালতে প্রথম বারের মত বর্ণভিত্তিক আসন পৃথকীকরণ ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করেন। সেদিন ছাপানো হ্যান্ডবিলগুলো বিলি করা হয় গোটা শহরে। হ্যান্ডবিলে সোমবার দিন বাস বয়কটের আহ্বান জানানো হয়। সেদিন বৃষ্টি উপেক্ষা করে বাস বয়কটের আন্দোলনে একাত্ম হন প্রতিটি কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ। কালোদের চালানো ক্যাবগুলো বাসের ভাড়ার মতই ১০ পয়সায় যাত্রীবহন করে। শহরের ৪০ হাজার কৃষ্ণাঙ্গের প্রায় সবাই হেঁটে চলাচল করে, অনেকেরই অন্তত ৩০ কিলোমিটার হাঁটতে হয় বয়কটের দিন। এক দিনের সফল বাস বয়কটের পর আন্দোলনের কৌশল নিয়ে আলোচনায় বসলেন নেতারা, যেখানে উপস্থিত ছিলেন পার্কসও। বয়কট চালিয়ে নিয়ে আন্দোলন জোরদারের উদ্দেশ্যে মন্টেগোমারি ইম্প্রুভমেন্ট এসোসিয়েশন নামে একটি সংগঠন গঠন করা হলো। এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন পরবর্তীতে কিংবদন্তিতে পরিণত হওয়া কৃষ্ণাঙ্গ নেতা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র, যদিও সে সময় তিনি আন্দোলনের সংগঠক হিসেবে ছিলেন একেবারেই নতুন। এদিকে বয়কট শুরু হলো পুরোদমে। বাস মালিক আর শহরের সরকার ভেবেছিলো কত দিনই বা আর এই কালোগুলো বাস ব্যবহার না করে থাকতে পারবে! কিন্তু তাদের চিন্তাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বয়কট চলতে লাগলো দিনের পর দিন। যাদের গাড়ি ছিল তারা ফ্রি রাইড দিয়ে অন্যদের সহায়তা করতে লাগলো। কৃষ্ণাঙ্গরা হাঁটতে লাগলো প্রতি দিন মাইলের পর মাইল। কৃষ্ণাঙ্গ ক্যাব চালকেরা তাদের জন্য ভাড়া নিতে লাগলো ১০ পয়সা করে। একে ঠেকাতে আইন জারি হলো, কোনো ক্যাব চালক ৪৫ পয়সার কম ভাড়া নিতে পারবে না। এই আন্দোলনের জন্য কৃষ্ণাঙ্গদের চার্চগুলো থেকে সারা দেশে অর্থ সংগ্রহ করা হলো। অল্প ব্যবহৃত জুতা সংগ্রহ করা হলো কারণ হাঁটতে হাঁটতে তাদের জুতা ক্ষয়ে যেতো অল্প সময়েই। আন্দোলনের নেতা এডগার নিক্সন ও মার্টিন লুথার কিং এর বাড়িতে আক্রমণ করা হলো। এগুলো ঘটার পরও প্রতিশোধের বদলে অহিংস পথে আন্দোলন চলতে থাকে। বয়কটের সময় যেসব গাড়ি ব্যবহৃত হচ্ছিলো সেগুলোর বীমা কোম্পানিগুলো গাড়ির বীমা বন্ধ করে দিলো স্থানীয় সরকারের চাপে পড়ে। তখন বয়কটের নেতারা ‘লয়েড অব লন্ডন’ নামক এক কোম্পানির ব্যবস্থা করলেন এই গাড়িগুলোর বীমা করার জন্য। টানা বয়কটের কারণে বাসগুলো অচল হয়ে পড়ে রইলো। বাসের কোম্পানিগুলো বিশাল আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়লো। মার্টিন লুথার কিং সহ ৯০ জন নেতার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হলো ব্যবসায় বাধা সৃষ্টির অভিযোগে। তারা একত্রে আত্মসমর্পণের জন্য হাজির হলেন। মার্টিন লুথার কিং কে ৫০০ ডলার জরিমানা আর অনাদায়ে ৩৮৬ দিন কারাদণ্ড দেওয়া হলো। তিনি কারাবরণ করলেন। দুই সপ্তাহ পর কারাগার থেকে বের হয়ে তিনি ঘোষণা দিলেন, “আমি আমার অপরাধের জন্য গর্বিত। অবিচারের বিরুদ্ধে আমার লোকদের সাথে অহিংস আন্দোলনে যোগ দেওয়াটাই ছিলো আমার অপরাধ।” যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে সাধারণ মানুষের অব্যাহত সমর্থনের চাপ বাড়তে থাকে। ১৯৫৬ সালের ৪ জুন স্থানীয় আদালত বর্ণবাদী আইনের বিরুদ্ধে রায় দেন। মন্টেগোমারি শহর কর্তৃপক্ষ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে। মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট মার্কিন সংবিধানের ১৪তম সংশোধনীর লঙ্ঘন হিসেবে অ্যালাবামা রাজ্য এবং মন্টেগোমারি শহরের বাসের আসন সংরক্ষণসংক্রান্ত আইনগুলো বাতিল করেন। এরপর ২০ ডিসেম্বর বাসে কোনো কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তি যে সিটে ইচ্ছে সে সিটে বসে যেতে পারবেন এমন আদেশ দিলে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র বাস বয়কট প্রত্যাহার করেন। ৩৮১ দিন বয়কট আন্দোলন চলার পর বয়কটের সফল সমাপ্তি ঘটে। বয়কট-পরবর্তী সময়ে প্রথম যাত্রী হিসেবে বাসে ওঠেন রোজা পার্কস। মানুষের বিরুদ্ধে মানুষের এই অত্যাচার আজকের পৃথিবীতেও চলছে অজস্র স্থানে। যারা এমন অন্যায়ের শিকার, যারা সহ্য করে চলেছেন দিনের পর দিন মুখ বুজে, তাদের জেগে ওঠার জন্য রোজা পার্কস অনন্য উদাহরণ হয়ে আছেন। পার্কস তার আত্মজীবনী ‘মাই স্টোরি’ তে লিখেন, “লোকে প্রায়ই বলে, আমি নাকি সেদিন খুব ক্লান্ত ছিলাম বলে আমার সিট ছাড়ছিলাম না। কথাটা সত্য নয়। আমি শারীরিকভাবে ক্লান্ত ছিলাম না, অন্য দিন কাজের শেষে আমি যে পরিমাণ ক্লান্ত থাকি সেদিন ততটুকুও ছিলাম না। আমার বয়স বেশি ছিল না। যদিও অনেকের ধারণা আমি তখন বৃদ্ধ ছিলাম। আমার বয়স ছিল মাত্র বিয়াল্লিশ। আমি শুধু একটা কারণে ক্লান্ত ছিলাম। আমি ক্লান্ত ছিলাম ছাড় দিতে দিতে।” নাগরিক অধিকার আন্দোলনের জননী রোজা লুইস ম্যাকলি পার্কস ১৯১৩ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যালাবামার টাস্কেগি শহরে। রোজার পিতার নাম জেমস ম্যাককাউলে এবং মাতা লিওনা। ২০০৫ সালের ২৪ অক্টোবর তিনি মিশিগান রাজ্যের ডেট্টয়েট শহরে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে ওয়াশিংটন ডিসির ‘ইউএস ক্যাপিটল রোটুন্ডা’য় সমাহিত করা হয়। প্রথম নারী এবং দ্বিতীয় কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তি হিসেবে তিনি এই বিরল সম্মাননা পেয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটাল হিলের ভাস্কর্য সেকশনে তার ভাস্কর্য উন্মুক্ত করা হয়। ক্যালিফোর্নিয়া ও মিসোরিতে ৪ ফেব্রুয়ারি তার জন্মদিনকে রোজা পার্কস দিবস হিসেবে পালন করা হয়। ওহাইও এবং অর্গানে ১ ডিসেম্বর তাঁর গ্রেফতার হওয়ার দিনকে রোজা পার্কস দিবস হিসেবে পালন করা হয়। রোজা পার্কস ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন মানবাধিকারকর্মী যাকে ইউনাইটেড স্টেট কংগ্রেস অভিহিত করেছে ‘দ্য ফার্স্ট লেডি অব সিভিল রাইটস’ এবং ‘দ্য মাদার অব দ্য ফ্রিডম মুভমেন্ট’ হিসেবে। তাঁর জন্মদিন এবং গ্রেফতার হবার দিন দুটোই রোজা পার্কস দিবস হিসেবে পালিত হয়। বছরে দুবার এক ব্যক্তিকে নিয়ে দিবস পালন পৃথিবীজুড়ে বিরল। এখনও পৃথিবীতে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে রোজা পার্কস প্রেরণা যোগান। নীরবে নিভৃতে সব সয়ে যাওয়া নয় বরং সাহসের সঙ্গে সকল প্রতিকূলতা ডিঙাতে হয় সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন দ্য ফার্স্ট লেডি অব সিভিল রাইটস; রোজা লুইস ম্যাকলি পার্কস।