যোগ বা ইয়োগা এখন সকলের নিকট অতি পরিচিত। সাম্প্রতিককালে আধুনিক সমাজে বেশ প্রচলন বেড়েছে যোগ ব্যায়ামের। যোগ আমাদের দেহ মন প্রাণকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সুস্থ রাখে, নীরোগ ও নিরাময় করে, যা আমাদের সকল কাজকর্মের মধ্যে শান্ত সুষম ছন্দ সঞ্চার করে। বর্তমানে জাতিসংঘের অনুমোদনে ২১ জুন সারাবিশ্বে পালিত হয় আন্তর্জাতিক যোগ দিবস।
যোগানুশীলনের উপকারিতা সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী মানুষের মাঝে সচেতনতা গড়ে তোলার জন্যই দিনটির সৃষ্টি। যোগানুশীলন একটি প্রাচীন জীবনাচরণ পদ্ধতি যার মাধ্যমে শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করা সম্ভব। ভারতের ত্রিকালজ্ঞ ঋষিরা বুঝেছিলেন, শুধু পার্থিব চিকিৎসা ব্যক্তির শরীরের ব্যাধির কিছু উপশম করলেও তাঁর সার্বিক কল্যাণের জন্যে অপার্থিব কিছু প্রয়োজন। যোগ হচ্ছে পার্থিব-অপার্থিবের সেই আশ্চর্য সম্মিলন যার মধ্য দিয়ে মানুষ শরীরে ও মনে সুস্থ জীবন যাপন করতে পারে।
বিভিন্ন চিকিৎসার জটিল প্রক্রিয়ায় ও প্রায়োগিক প্রতিক্রিয়ায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে আজকের মানুষ যোগচিকিৎসা গ্রহণ করতে আগ্রহী হয়ে উঠছে। মনে করা হয় পৃথিবীর প্রাচীনতম সিন্ধু সভ্যতার সময় থেকেই যোগের উদ্ভব ঘটেছিল। বৈদিকযুগে যোগের বহুল প্রচার ছিল এবং বুদ্ধদেবের সাধনা ও শিক্ষণের একটি বড় অংশ জুড়ে আছে যোগ ও ধ্যান। যোগ মানুষের চেতনার সীমাহীন প্রসার ঘটায় ফলে মনের অন্ধকার দূর হয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে নৈতিক জীবনের সর্বাঙ্গীণ বিকাশ সাধিত হয়। পৃথিবীর সর্বত্রই আজ যোগ অনুশীলিত হয়ে থাকে। যোগ এখন বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য ও কুশল-শিল্পের এক অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে।
যোগানুশীলন যেহেতু শরীর-মন সম্পর্কে অবগত হতে সাহায্য করে, কাজেই যোগ শরীরের সঙ্গে সংযোগ সাধন করে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে স্বামী বিবেকানন্দ আমেরিকা এবং ইউরোপে বিশুদ্ধ যোগের বহুল প্রচার করেন। পরবর্তীকালে পরমহংস যোগানন্দ তাঁর প্রতিষ্ঠিত স্থাপনা সেল্ফ রিয়েলাইজেশন ফেলোশিপের মাধ্যমে লস এঞ্জেলেস থেকে যোগের একটি সুন্দর শিক্ষাক্রম তৈরি করে দূরশিক্ষণ প্রক্রিয়ায় যোগের প্রচার করেন।
সূর্যের কিরণ যেমন স্থান কাল পাত্র বিবেচনা না করে সর্বত্র সমানভাবে আলোকিত করে তেমনি যোগের আলো আমাদের অন্তর এবং বাহিরকে যুগপৎ উদ্ভাসিত করে তোলে। একটি গাড়ি ঠিকমত চালানোর জন্য যেমন উপযুক্ত একটি পরিবহন যন্ত্র, জ্বালানি বা শক্তির যোগান এবং দক্ষ চালকের প্রয়োজন তেমনি আমাদের পার্থিব জীবনপ্রবাহেও একটি নীরোগ শরীর, অফুরন্ত প্রাণপ্রাচুর্য এবং পরিশীলিত মনের একান্ত প্রয়োজন। যোগ এই দেহ, প্রাণ এবং মনের ভারসাম্য বজায় রেখে আমাদের সুস্থ এবং সৃষ্টিশীল রাখে। আমাদের সবরকম রোগের মূল কারণ প্রতিরোধ ক্ষমতার স্বল্পতা এবং স্ট্রেস। যোগ আমাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা পর্যাপ্ত করে এবং সর্বতোভাবে স্ট্রেস নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে।
যোগ শব্দটি সংস্কৃত ‘যুজ্’ ধাতু থেকে উদ্ভুত যার মানে যুক্ত করা। যোগ আমাদের শরীর মন প্ৰাণকে অন্তহীন উৎসের সঙ্গে যুক্ত করে। মন ও শরীরকে একত্রিত করে যোগ ব্যায়াম। একইভাবে আমাদের পারিপার্শ্বিক সমস্যা মোকাবিলায় ও সুখে থাকার জন্য যোগ ব্যায়াম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
যোগব্যায়াম বা যোগাসন শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে খুবই উপকারী। সুস্থ ও ফিট থাকতে চিকিৎসকরাও যোগাব্যায়ামের পরামর্শ দেন।
দিনের দুটি সময়ে যোগভ্যাস করলে উপকার পাওয়া যায়। প্রথমত, ভোরবেলা। সূর্য উদয় হওয়ার পর। দ্বিতীয়ত সূর্য অস্ত যাওয়ার সময়, অর্থাৎ সন্ধ্যাবেলায় যোগ করলে মিলবে উপকার। ভোরবেলা যোগচর্চা করলে সারাদিন শরীর থাকে চাঙ্গা। এদিকে উল্টো দিকে সন্ধেবেলায় শরীর অনেকটা নমনীয় হয়ে পড়ে। তাই কঠিন-জটিল ব্যায়াম করার পক্ষে এই সময়টাও একদম আদর্শ।
সম্প্রতি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁর আমেরিকা সফর শুরু করেছিলেন যোগ কার্যক্রমে অংশ নিয়ে যা গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস গড়ে। সাদা রঙের টি-শার্ট এবং একটি হালকা ট্রাউজারস পরে মোদি একসঙ্গে ১৩৫টি দেশের মানুষকে যোগাসনে নেতৃত্ব দেন।
উক্ত কার্যক্রমে যুক্ত হওয়া অর্থ্যাৎ যোগাসনে বসা মানুষের উদ্দেশে এক বক্তব্যে মোদি বলেন, ‘যোগাসনের কোনো কপিরাইট হয় না। এর কোনো পেটেন্ট কিংবা মালিকানাও নেই। এটা সুললিত। আপনি এটা দলবদ্ধ হয়ে করতে পারেন কিংবা একা একাও করতে পারেন। কারও কাছ থেকে এর দীক্ষা নিয়ে কিংবা নিজে নিজেও এটি শিখতে পারেন। এটা ঐক্যবদ্ধ করে এবং সত্যিকার অর্থেই সর্বজনীন। এটা সব গোত্র, বিশ্বাস এবং সংস্কৃতির জন্য।’
বিশ্ব যোগ দিবস পালনের প্রস্তাবকও হচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। জাতিসংঘে ২০১৪ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ভাষণ দেওয়ার সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২১ জুন তারিখটিকে আন্তর্জাতিক যোগ দিবস বলে ঘোষণা করার প্রস্তাব দেন। সেই বছরই ১১ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ২১ জুন তারিখটিকে আন্তর্জাতিক যোগ দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন।
বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ উভয় দিক থেকেই নিজেদের সংহত করে তোলার প্রত্যয়ে সারা পৃথিবীর মানুষ এদিন যোগ ব্যায়ামের প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করে। বর্তমানে ডিজিটাল যুগের ব্যস্ততার মধ্যে একজন মানুষ যোগ ব্যায়ামের মাধ্যমে তার মন, শরীর ও হৃদয়ের মেলবন্ধন ঘটাতে পারেন। পেতে পারেন এক অদ্ভুত শান্তির অনুভূতি। সুস্থ সবল থাকার জন্য যোগাভ্যাস করা অত্যন্ত জরুরি। বিশ্বব্যাপী ঐক্য গড়ে তুলতে যোগাসনের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।