ডক্টর কালী প্রসন্ন দাসের সাথে পরিচয় “বড়লেখা: অতীত ও বর্তমান” বইটির সূত্র ধরে। তিনি এই গ্রন্থটির সম্পাদক ছিলেন। বড়লেখার যে কজন ব্যক্তি বিশ্বময় আলো ছড়িয়েছেন ইতিবাচক কর্ম দিয়ে তারমধ্যে অন্যতম একজন হলেন ডক্টর কালী প্রসন্ন দাস। তাঁর সাথে মাঝে-মধ্যে আলাপ হতো নানান বিষয় নিয়ে। ২০০৮ সালের দিকে হাকালুকি অঞ্চলের আরেক কৃতি সন্তান, শিশু সাহিত্যিক, কবি মৃণাল কান্তি দাস আয়োজন করলেন ‘আলো চাই মেধাবৃত্তি পরীক্ষা’র। বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের অনুপ্রেরণা দিতে আমন্ত্রণ জানালাম তাঁকে, সানন্দে রাজি হলেন এবং অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকলেন। হাকালুকি উচ্চ বিদ্যালয়ের হলরুমে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি নাট্যব্যক্তিত্ব ম. হামিদ ও আমাদের মাটির সন্তান কালী প্রসন্ন দাসের অনবদ্য বক্তব্য চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। ২০১৩ সালের দিকে উনার অনুবাদে রচিত “ভারতীয় ও পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যা” নামক একটি গ্রন্থ উপহার পেলাম। এ গ্রন্থে ভারতীয় নয়টি দার্শনিক সম্প্রদায় এবং পাশ্চাত্য দর্শনের প্রাচীন–মধ্য-আধুনিক যুগের প্রখ্যাত দার্শনিকদের জ্ঞানোৎপত্তি বিষয়ক মতবাদ আলোচিত হয়েছে। প্রতীকী যুক্তিবিদ্যাসহ বেশ কয়েকটি বইয়ের সফল অনুবাদক তিনি। একজন শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক, গ্রন্থকার, অনুবাদক, সমাজকর্মী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন নিজের সৃজনশীল কর্ম দিয়ে।
আমাদের বড়লেখার গুণীজন, প্রিয় মানুষটি ২০২২ সালের এইদিনে (২৯ মে) দেহত্যাগ করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যবরণ করে তিনি মরণোত্তর দেহ দান করে গেছেন শিক্ষার্থীদের কল্যাণে মগবাজারস্থ ঢাকা কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে।
ডক্টর কালী প্রসন্ন দাস ১৯৫৯ সালের ১৪ মে মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলার ঘোলসা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমিখ্যাত মাধবকুণ্ড জলপ্রপাতসংলগ্ন বাগানবাড়িতে শিশু বয়স থেকে বেড়ে উঠেছেন। মাধবকুণ্ডের অনেক রহস্যময় গল্প শুনেছি উনার নিকট হতে। কালী প্রসন্ন দাসের ছোট ভাই কৃষ্ণ প্রসন্ন দাস নিলুও দেখা হলে অনেক গল্প করতেন মাধবকুণ্ড নিয়ে। তিনিও পৃথিবী ছেড়েছেন বেশ কয়েক বছর আগে। উনার বাবা কৃপাসিন্ধু দাস এবং মা তরঙ্গলতা দাস বেশ সাহসের সঙ্গে মাধবকুণ্ড এলাকায় বসবাস করতেন। দুজনেই প্রয়াত। কালী প্রসন্ন দাস মৃত্যুকালে তাঁর সহধর্মিনী কাজী রোজেনা আক্তার, পুত্র ইসতি অদিত সহ অসংখ্য শুভাকাঙ্ক্ষী রেখে গেছেন।
তিনি বড়লেখা থেকে এসএসসি (১৯৭৫) সম্পন্ন করে সিলেটের খ্যাতনামা এমসি কলেজ থেকে এইচএসসি (১৯৭৮), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে বিএ অনার্স (১৯৮২), এমএ (১৯৮৪), এমফিল (১৯৯৩) এবং কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিবেশ দর্শনে পিএইচডি (২০১০) সম্পন্ন করেন।
১৯৮৭ সাল থেকে তিনি সাভার বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে দর্শন বিভাগে শিক্ষকতা করতেন। মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে ছিল তার বিশেষ আগ্রহ। তিনি শিক্ষকতার পাশাপাশি ট্রানজেকশনাল এনালাইসিস এন্ড নিউরো-লিঙ্গুইস্টিক প্রোগ্রামিং-এ ডিপ্লোমা নিয়ে সাইকো-সোশ্যাল কাউন্সেলিং করতেন।
আন্তর্জাতিক কর্মশালায় যোগ দিতে ডক্টর কালী প্রসন্ন দাস ভারত, নেপাল, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, পর্তুগাল, প্যারাগুয়ে এবং আমেরিকার সানফ্রান্সিসকোতে ভ্রমণ করেছেন।
তিনি ব্যক্তিজীবনে অসাম্প্রদায়িক, কুসংস্কারমুক্ত, যুক্তিবাদী ও মুক্তবুদ্ধির অধিকারী ছিলেন। শিক্ষকতায় তিনি তাঁর মনপ্রাণ ঢেলে দেন। শিক্ষার্থীদের সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল গভীর ও অকৃত্রিম। মানিকগঞ্জে প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘জায়গীর প্রাথমিক বিদ্যালয়’ এবং ‘উত্তর বাকচর প্রাথমিক বিদ্যালয়’, যেটি বর্তমানে ‘উত্তর বাকচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’ নামে সুপরিচিত। এখান থেকে প্রতিবছর বের হয় এক ঝাঁক মেধাবী শিক্ষার্থী।
‘প্রাঙ্গন’ নামে তার একটি সামাজিক উদ্যোগ ছিল, যেখান থেকে মেধাবী শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার সুব্যবস্থা করতেন। বন্ধুবৎসল এবং সুভাষী মানুষটি আমৃত্যু ছিলেন একজন দাতা। জ্ঞানদান করেছেন অকাতরে। সুযোগ পেলেই জ্ঞানের আলো ছড়াতেন, সেইসাথে শিক্ষার্থীদের দিতেন প্রয়োজনীয় পরামর্শ। তাছাড়া রক্তদানে তিনি ছিলেন অনন্য। মানবতাবাদী মানবিক এ মানুষটি মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত ৬০ বার রক্তদান করেছেন।
ডক্টর কালী প্রসন্ন দাসের প্রয়াণ দিবসে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।