ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। শুক্রবার রাতভর দেশটির রাজধানী তেহরান, খুজেস্তান ও ইলাম প্রদেশে হামলা চালায় ইসরায়েল। ইরানের সেনাবাহিনী বলেছে, ইসরায়েলি হামলায় তাদের দুই সেনার মৃত্যু হয়েছে। ইরানের বিমান প্রতিরক্ষা বাহিনী দাবি করেছে, তারা ইসরায়েলের আক্রমণ ব্যর্থ করে দিয়েছে। শুধু তা নয়, ইরান ঘোষণা করেছে অচিরেই তারা এর জবাব দেবে। দু’পক্ষ যে একটা পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের মুখোমুখি, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
সম্প্রতি অর্থনীতিবিষয়ক সংবাদপত্র দ্য মার্কার এক প্রতিবেদনে বলেছে, ইসরায়েলি সরকার কয়েক মাস আগে গঠিত নাগাল কমিশনকে প্রধান প্রধান অস্ত্র চুক্তির অনুমোদনে দ্রুত সিদ্ধান্তের সুবিধার্থে প্রতিরক্ষা বাজেট নিয়ে পরামর্শ দিতে অনুরোধ করেছে। ইসরায়েলের সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের সাবেক গবেষণাপ্রধান অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ইয়োসি কুপারওয়াসার দেশের সেনাবাহিনীর সামনে চ্যালেঞ্জের মাত্রা বোঝাতে গিয়ে বিষয়টি সামনে এসেছে।
‘ইসরায়েল হায়োম’ পত্রিকায় একটি নিবন্ধে তিনি উল্লেখ করেছেন, তেল আবিবের কৌশলটি ইরান অক্ষকে দুর্বল করা। এই কৌশলের মধ্যে রয়েছে উত্তরের বাসিন্দাদের নিরাপদে বাড়িতে ফিরে যেতে জিম্মিদের মুক্ত করতে উত্তরাঞ্চলের হুমকি বন্ধ করা এবং গাজা থেকে ইসরায়েলি রাষ্ট্রের হুমকি অপসারণ করতে নিজেদের সক্ষম করার জন্য উত্তর থেকে হুমকি দূর করা। এ সবই একটি দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের ইঙ্গিতবহ, যেখানে ক্রমবর্ধমানভাবে সামরিক সক্ষমতা বাড়ানোর প্রয়োজন হবে। ইসরায়েলের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবগুলো ইঙ্গিত দেয়, লেবাননও হয়তো ইরানের সঙ্গেও যুদ্ধ বাড়ানোর খরচ হবে ব্যাপক, যা ২০২৪ ও ২০২৫ সালের জন্য ইসরায়েলের বর্ধিত সামরিক ব্যয়ে খানিকটা হলেও বোঝা যাচ্ছে।
যদিও ইসরায়েলি যুদ্ধের বাজেট বিস্তারিতভাবে প্রকাশ করা হয়নি, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন পূর্বাভাসগুলো একটি ইঙ্গিত দেয়। এ বছর বর্তমান ব্যয় ৩০ বিলিয়ন শেকেল (৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) বাড়বে। এটি এমন একটি সংখ্যা, যেখানে প্রাথমিকভাবে সামরিক সরঞ্জাম, গোলাবারুদ এবং সেনাদের কাজের জন্য ক্ষতিপূরণ সংরক্ষিত থাকবে। একদিকে কমিশনের সুপারিশের বিশদ বিবরণ গোপনীয় থাকবে; আর এদিকে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সরকার কমিশন থেকে উন্নত অস্ত্রের ব্যবহারের শিগগির বরাদ্দ চায়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বরাদ্দগুলো মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ইসরায়েলি যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হবে এবং কমপক্ষে ২০২৫ সালের প্রথম তিন মাস পর্যন্ত চলবে– এই ধারণার ভিত্তিতে তৈরি। এমনকি লেবানন ও ইরানের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধির আগেও ব্যাংক বুঝতে পেরেছিল, সব ধরনের আশা ছাড়িয়ে দেশটির সামরিক ব্যয় বেড়েছে। এটি কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ইসরায়েলের ২০২৪ সালের বাজেটে রাজস্ব ঘাটতির কারণে আগে থেকেই ০.৬ শতাংশ বাড়াতে উৎসাহিত করেছিল, যা মোট দেশীয় পণ্যের ৭.২ শতাংশ অন্তর্ভুক্ত করে। এই বছর ইসরায়েলের হালনাগাদকৃত সামরিক ব্যয়ের পরিমাণ ১৩০ বিলিয়ন শেকেল (৩৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার), যেখানে সীমান্ত এলাকা থেকে বাসিন্দাদের স্থায়ী বাস্তুচ্যুতির খরচ ৩ বিলিয়ন থেকে বেড়ে ৫ বিলিয়ন শেকেল হয়েছে। এ ছাড়া ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ক্ষতিগ্রস্ত সম্পত্তির ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ ১.৫ বিলিয়ন শেকেলে (৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) পৌঁছেছে।
প্রতিবেদনগুলো ইঙ্গিত দেয়, স্থানীয় কর থেকে রাজস্বের একটি উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি সামগ্রিক বাজেটে সামরিক ব্যয়ের চাপ কিছুটা কমিয়ে দিতে পারে। এখানে আসন্ন মার্কিন আর্থিক সহায়তার কোনোটাই হিসাবে করা হয়নি। এদিকে ঘাটতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ইসরায়েলের অর্থ মন্ত্রণালয় তার বহু বার্ষিক পরিকল্পনায় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে একটি অতিরিক্ত বাজেট বরাদ্দ করার ইঙ্গিত দিয়েছে। এতে ২০২৩ ও ২০২৪ সালের জন্য মোট ৮৩ বিলিয়ন শেকেলের ($২২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে অতিরিক্ত মার্কিন সামরিক সহায়তা সংগ্রহের জন্য প্রাথমিকভাবে ১৬ বিলিয়ন শেকেল এ পর্যন্ত খরচ করা হয়েছে।
ইসরায়েল আঞ্চলিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের ভিত্তিতে সামরিক কাঠামোতে ব্যাপক পরিবর্তন আনছে। দীর্ঘপাল্লার আঞ্চলিক যুদ্ধ অগ্রাধিকার দিয়ে স্থল ও নৌবাহিনী উভয়ের ওপরই তারা মনোযোগ দেবে। ইসরায়েলের উত্তর ফ্রন্টে মার্কিন সমর্থিত যুদ্ধটি তার আঞ্চলিক পরিকল্পনার একটি মাত্র অংশ। উদ্দেশ্য ইরানের তৈরি প্রতিরোধের অক্ষকে ভেঙে ফেলা এবং ‘সম্মুখযুদ্ধের ঐক্য’ কৌশল দুর্বল করা।
গাজায় যুদ্ধ দীর্ঘ সময়ের জন্য চলতে থাকবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। হয়তো ভূখণ্ডের উত্তর অংশে জাতিগত নির্মূল অভিযানের ভিত্তিতে স্থায়ীভাবে দখলের প্রচেষ্টা থাকবে। ইসরায়েলি অর্থনীতির শক্তি ও রিজার্ভ সম্পদ সত্ত্বেও তেল আবিব ক্রমবর্ধমানভাবে সামরিক, আর্থিক ও কূটনৈতিক বিষয়ে মার্কিন সমর্থনের ওপর নির্ভরশীল। এভাবে ইসরায়েলের যে কোনো আঞ্চলিক যুদ্ধ মূলত মার্কিন যুদ্ধ বলেই বিবেচিত হবে। কারণ, তেল আবিব ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীর অধিকার অস্বীকার করে তাদের শেষ করে দেওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রাখবে।
আমির মাখউল: ফিলিস্তিনি কর্মী ও লেখক; মিডল ইস্ট আই থেকে ভাষান্তর ইফতেখারুল ইসলাম