জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২ অনুযায়ী বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জনসংখ্যা ১৬ লাখ ৫০ হাজার ১৫৯ জন।
জনশুমারিতে দেশের ৫০টি জাতিসত্তার জনসংখ্যা তুলে ধরা হয়। বাংলাদেশের সংবিধানের ২৩(ক) অনুচ্ছেদে ‘উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছরেও নিজেদের জন্য যুৎসই ‘আদিবাসী’ শব্দটির অধিকার আদায় করতে পারেননি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর লোকজন তাই বাংলাদেশের সংবিধানের প্রতি সম্মান জানিয়ে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী শব্দটিই ব্যবহার করছি।
জাতিসংঘের উদ্যোগে প্রতিবছর ৯ আগস্ট আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস পালিত হয়। উল্লেখ্য যে, জাতিসংঘ ২০২২ সাল থেকে ২০৩২ সাল পর্যন্ত একটি নতুন ‘আদিবাসী ভাষা দশক’ ঘোষণা করেছে। জাতিসংঘের তথ্য মতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রচলিত ৭ হাজার ভাষার মধ্যে কমপক্ষে ৪০ শতাংশ ভাষা বিলীন হওয়ার পথে আছে। তন্মধ্যে সবচেয়ে বেশি হুমকির মুখে আছে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভাষা। মাতৃভাষা রক্ষার জন্য প্রাণ দেওয়া জাতি আমরা অথচ নিজদেশে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অনেক ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে সেগুলো রক্ষায় নেই যথাযথ উদ্যোগ।
বাঙালির সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যেরও অবদান রয়েছে। সেটা স্বীকার করার বদলে বিভিন্ন সময়ে নানামুখী উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও পর্যটনের নামে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বসত ভিটা, আবাদী জমি কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এই প্রক্রিয়া এখনও চলমান আছে। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষের উপর প্রভাবশালীর নিপীড়ন-নির্যাতন হর-হামেশা ঘটে। এমন প্রেক্ষাপটে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের নিজস্ব সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন ধারা আজ সংকটাপন্ন।
বাংলাদেশের গারো জনগোষ্ঠীর আদি ধর্ম সাংসারেক, যে ধর্মের মূলমন্ত্র হলো প্রকৃতির উপাসনা। কালের পটপরিবর্তনে গারো জনগোষ্ঠী নিজেদের আদি ধর্ম চর্চা বাদ দিয়ে খ্রিষ্টান, হিন্দু, মুসলমান ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছে। মুষ্টিমেয় কিছু লোক ছাড়া সকলেই খ্রিষ্টান ধর্মে দীক্ষিত, সেই প্রেক্ষিতে খ্রিষ্ট ধর্মের রীতিনীতি মানতে গিয়ে গারো জনগোষ্ঠীর লোকজন নিজেদের সাংসারেক ধর্ম বিসর্জন দিয়েছেন। শেকড় ভুলে খুব শান্তিতে রয়েছেন এমন নয় বরং সুখের বদলে দুঃখই বেড়েছে। সাংসারেক ধর্ম নিজেদের প্রচারে বিশ্বাসী নয়, তাদের দর্শন নিজেদের মধ্যে চর্চায়। সেই চর্চায় অশান্তির বদলে রয়েছে প্রশান্তি।
গারোদের মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার ইতিহাস লড়াইয়ের ইতিহাস। কেবল প্রকৃতির সঙ্গে নয় তাঁদেরকে প্রতিনিয়ত লড়তে হয় প্রভাবশালীদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে, ভূমিদস্যুদের বিরুদ্ধে, শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে। মৌলিক অধিকার আদায়ে আজীবন সংগ্রামরত এই জনগোষ্ঠীর লোকজনের লড়াই-সংগ্রাম রক্তের সঙ্গে মিশে গেছে। স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে প্রায় হারিয়ে যাওয়া সাংসারেক ধর্ম চর্চার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সাংসারেক কমিউনিটি বাংলাদেশ নামক তরুণ প্রজন্মের গড়া একটি সংগঠন। নিজেদের শেকড়ের খুঁজে পথ চলতে গিয়ে প্রতিটি পদক্ষেপে তাঁদের লড়তে হচ্ছে ঘরে এবং বাহিরে। দেখে মনে হলো এই লড়াকু সৈনিকেরা দমে যাওয়ার নয়, আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান এই নবীন প্রজন্মের প্রতিটি পদক্ষেপ জানান দিচ্ছে তাঁদের মধ্যে নেই কোন ভয়।
বর্তমানে সাংসারেক ধর্ম চর্চা যাঁরা করছেন তাঁদেরকে প্রতিনিয়ত বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। খ্রিষ্ট ধর্মীয় রীতির সঙ্গে কিছুটা সাংঘর্ষিক এমনটাই মনে করছেন খোদ গারো জনগোষ্ঠীর লোকজন। ঘরের শত্রু বিভীষণ কথাটাও এখানে জুড়ে দেওয়া যায়। তবে সকল নেতিবাচক সমালোচনা দুরে রেখে সাংসারেক গারোদের অস্তিত্ব রক্ষায় নতুন যুদ্ধে নামা সাংসারেক কমিউনিটি বাংলাদেশ সম্প্রতি মধুপুর উপজেলার জলছত্রের আমলীতলা মাঠে সাংসারেক ধর্মের পরিপূর্ণ রীতি মেনে বর্ণাঢ্য আয়োজনে পালন করলো আ’বিমা ওয়ানগালা।
আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান এই অরুণ প্রাতের তরুণ দলকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে বলে মনে হয় না। সাংসারেক রীতির অতীত সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও মূল্যবোধ সংরক্ষণের মধ্যদিয়ে পুরোপুরি সাংসারেক ধর্ম চর্চায় ফিরতে চায় তাঁরা। সাংসারেক ধর্মে ইহলৌকিক আচারগুলো প্রকৃতি ও মানুষের কল্যাণে নিবেদিত। সাংসারেক ধর্মের কোনো ধর্মগ্রন্থ নেই।
তাই অনুসারীর পরম্পরায় চলছে ধর্মের আচার-অনুষ্ঠান। খুব অল্প সংখ্যক গারো এই ধর্মটিকে লালন করছেন। এরই প্রেক্ষিতে সাংসারেক কমিউনিটি বাংলাদেশ তাঁদের আদি ধর্মের মর্মকথা সকল ধর্মের মানুষের নিকট পৌছে দিতে এবারের আ’বিমা ওয়ানগালা অনুষ্ঠান সকলের জন্য উন্মুক্ত রাখে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের অংশগ্রহণ এবং মিডিয়ায় আয়োজন নিয়ে প্রচার-প্রচারনা ওয়ানগালাকে মহিমান্বিত করে তুলেছে। গারোদের আদিধর্ম সাংসারেক বহু-দেবতা ভিত্তিক।
ফসলের যোগানদাতা-রক্ষাকর্তা সালজং দেবতাকে ফসল উৎসর্গ করাই ওয়ানগালার মূল আয়োজন।
গারোরা উৎপাদিত ফসল দেবতাকে পূজা-অর্চনার মাধ্যমে উৎসর্গ করে তারপর নিজেরা ভোগ করে থাকেন, ফসল উৎসর্গ না করে কেউ সেই ফসল ভোগ করেন না। ওয়ানগালার যাবতীয় আচার-অনুষ্ঠান ঘিরে থাকে দেবতাকে সন্তুষ্ট করা সেইসাথে ওয়ানগালাকে কেন্দ্র করে যে সমাগম ঘটে সেই মানুষগুলোর মধ্যে আনন্দ ভাগাভাগি। নতুন ফসলের আপ্যায়ন এবং এই আয়োজন ঘিরে সকলের সম্মেলন পরবর্তী বছরের ওয়ানগালা পর্যন্ত তৃপ্তির মধ্যে রাখে।
ব্রহ্মপুত্রের এপার থেকে ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, মধুপুর, গাজীপুর এবং ঢাকা পর্যন্ত অঞ্চলে বসবাসকারী গারো সম্প্রদায়ের লোকজনকে আ’বিমা বলা হয়ে থাকে। এবারের আ’বিমা ওয়ানগালায় সাংসারেক রীতির অনুসরণ একটি অনন্য উজ্জল দৃষ্টান্ত। নবজাগরণের যে ঢেউ লেগেছে গারো নবীন প্রজন্মে সেই ঢেউয়ে ঐতিহ্য সুরক্ষিত হোক।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ছিল একটি অসাম্প্রদায়িক চেতনার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের অথচ পঞ্চাশ বছর পরেও এই দেশে জন্ম নেওয়া, এই দেশের জন্য লড়াই করা জনগোষ্ঠীকে ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহারের জন্য লড়তে হচ্ছে। এটা খুবই বেদনার। ক্ষুদ্র জাতিসত্তার নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি আজ অবহেলিত। এ দায় রাষ্ট্র এড়াতে পারে না। স্বাধীন দেশে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে সকলেই যেনো নিজ নিজ ধর্ম চর্চা করতে পারেন সেই ব্যবস্থা রাষ্ট্রকেই নিতে হবে।