
২০২৩ সালের ৬ অক্টোবরের আগে কেউ কল্পনাও করতে পারেনি, ইসরায়েল এত দ্রুত সারা দুনিয়ার সবচেয়ে ঘৃণিত রাষ্ট্রে পরিণত হবে। আজ ইসরায়েল নামটা গণহত্যা, পরিকল্পিত ধর্ষণ, নৃশংসতা ও শিশুহত্যার প্রতিশব্দ হয়ে গেছে।
ইসরায়েল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বিশেষ করে টিকটকের বিরুদ্ধে এমনভাবে অ্যান্টিসেমিটিজম বা ইহুদিবিদ্বেষের অভিযোগ তুলছে, যেন এসব প্ল্যাটফর্ম ইসরায়েলবিরোধী মতামত ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য দায়ী। তাদের ধারণা, তাদের প্রতি মানুষের ঘৃণার কারণ বর্বরতা নয়, আসল কারণ অ্যালগরিদম। তাই তারা মনে করে, যেভাবে তারা পশ্চিমা মূলধারার মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে, তেমনি যদি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকেও দখল করা যায়, তাহলে ইসরায়েলবিরোধী মনোভাবও থামানো সম্ভব।
প্রথম আঘাত এসেছে টিকটকের ওপর। নর্থ ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি ৭ অক্টোবরের পরপর টিকটকে ফিলিস্তিনপন্থী ও ইসরায়েলপন্থী বার্তা নিয়ে একটি গবেষণা করেছে। সেখানে দেখা যায়, ফিলিস্তিনপন্থী পোস্ট ছিল ১ লাখ ৭০ হাজার ৪৩০টি আর ইসরায়েলপন্থী পোস্ট মাত্র ৮ হাজার ৮৪৩টি। শুধু সংখ্যায় নয়, এনগেজমেন্টে ছিল বিশাল ফারাক। ফিলিস্তিনপন্থী পোস্ট দেখা হয়েছে ২৩৬ মিলিয়ন বার আর ইসরায়েলপন্থী পোস্ট দেখা হয়েছে মাত্র ১৪ মিলিয়ন বার।
দুই বছর পরেও ছবিটা বদলায়নি; বরং সময় যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরও বেশি মানুষ ফিলিস্তিনের পক্ষেই কথা বলছে। ৭ অক্টোবরের পরপরই কিছুদিনের জন্য ইসরায়েলপন্থী পোস্ট ও ভিউ বেড়েছিল। এটি ঘটেছিল ঘটনাটির তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে। কিন্তু কিছুদিন পর সেগুলো কমতে থাকে। অন্যদিকে ফিলিস্তিনের পক্ষে পোস্ট ও সমর্থন প্রতিদিনই বাড়ছে আর এই বাড়া কোনো হঠাৎ আবেগের মতো নয়-এটা টানা, বড় পরিসরের, দীর্ঘমেয়াদি এক আন্দোলনের মতো বিস্তার পাচ্ছে।
জায়নবাদীরা শুরুতেই এটি ধরে ফেলেন। আমেরিকার অ্যান্টিডিফেমেশন লিগের প্রধান জনাথন গ্রিনব্ল্যাটের এক ফাঁস হওয়া অডিওতে শোনা যায়, তিনি বলছেন, ‘আমাদের টিকটক সমস্যা আছে, জেনারেশন-জেড সমস্যা আছে। এটার সমাধান করতেই হবে।’ এরপর স্বভাবসুলভ জায়নবাদী কায়দায় তাঁরা মার্কিন রাজনীতির ক্ষমতার চাকা ঘুরিয়ে এবং টাকার জোরে সমস্যা মোকাবিলা শুরু করেন। হঠাৎই যুক্তরাষ্ট্রে দাবি ওঠে, চীন নাকি টিকটকের অ্যালগরিদম নিয়ন্ত্রণ করছে, আমেরিকান ইউজারদের ব্যক্তিগত ডেটা নিচ্ছে এবং এরপরই বলা হলো টিকটকের মার্কিন শাখা বিক্রি করে দিতে হবে।
আসল উদ্দেশ্য কিন্তু ছিল একদম স্পষ্ট। স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, টিকটককে টার্গেট করার কারণ চীন নয়। আসল কারণ ইসরায়েল ও তার ভাবমূর্তি রক্ষা করা। সুতরাং ‘ইসরায়েলকে আবার মহান বানানোর’ অভিযানে আমরা দেখলাম, রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটিক পার্টি—উভয় দলই একসঙ্গে টিকটকের বিরুদ্ধে দাঁড়াল এবং শেষ পর্যন্ত টিকটককে যুক্তরাষ্ট্রে তাদের অংশীদারত্ব বিক্রি করতে বাধ্য করা হলো।
কিন্তু কে কিনবে টিকটক? দেখা গেল, কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের একটি কনসোর্টিয়াম এগিয়ে এসেছে, যার মধ্যে প্রধান হলো ওরাকল।
ওরাকল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মার্কিন ধনকুবের ল্যারি এলিসন। তিনি বেশ কিছুদিন বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তির তালিকায় ছিলেন। তিনি সেনাবাহিনীর সবচেয়ে বড় ব্যক্তিপর্যায়ের চাঁদাদাতা এবং ‘ইসরায়েলের স্বার্থ আগে’-এমন ঘোষণা দেওয়া কট্টর জায়নবাদী।
নেতানিয়াহু ইতিমধ্যে আনন্দে আত্মহারা। তিনি নিজের অনুগতদের সঙ্গে এক আলোচনায় বলেছেন, ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধক্ষেত্র হলো সোশ্যাল মিডিয়া আর এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কেনাকাটা চলছে, তা হলো…টিকটক।’
এ যুদ্ধে নিজেদের জয় দেখে এখন তারা অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের দিকে নজর দিচ্ছে। তাদের পরের টার্গেট ‘এক্স’ (সাবেক টুইটার)। এরই মধ্যে ইসরায়েলি গণমাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে প্রবন্ধ ছাপা হচ্ছে যেখানে ‘এক্স’-কে ‘নতুন অ্যান্টিসেমিটিজমের আস্তানা’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। কিন্তু নেতানিয়াহু চিন্তিত নন। তিনি বলেছেন, ‘ইলন (মাস্ক) আমাদের বন্ধু…ওর সঙ্গে কথা বললেই হবে।’ অর্থাৎ তিনি কথা বলবেন, আর ইলন সে কথা মানবেন।
তারা কেবল সোশ্যাল মিডিয়া নয়, এআইয়ের দিকেও এগোচ্ছে। ইসরায়েল সরকার ট্রাম্পের সাবেক এক প্রচারপ্রধানের সঙ্গে ৬০ লাখ ডলারের একটি চুক্তি করেছে। ওই চুক্তি অনুযায়ী তারা নতুন ইসরায়েলপন্থী ওয়েবসাইট ও ভিডিও বানাবে, যেগুলোর ডেটা দিয়ে চ্যাটজিপিটিসহ বিভিন্ন বড় এআই মডেলকে প্রশিক্ষিত করা হবে।
এসবের লক্ষ্য একটাই-এআইকে ইসরায়েলি প্রোপাগান্ডা গেলানো, যাতে এআইও তাদের কথা বারবার বলে চলে। এভাবেই একটি গণহত্যার স্মৃতি ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার চক্রান্ত সাজিয়ে তোলা হচ্ছে।